মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৯ অপরাহ্ন
বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা:) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দিন অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে হিজরি সন গণনা করা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা হিজরি সনের যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন তা হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও সফর। এ চারটি মাসের মধ্যে মহররম অন্যতম ফজিলতপূর্ণ, বরকতময় মাস। হিজরি বছরের পয়লা মাস এবং বর্ষপঞ্জি খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর রা:-এর শাসনামলে ১৭ হিজরি বা রাসূলের ইন্তেকালের সাত বছর পর প্রচলন করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বমুসলিমকে নতুন প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে আসছে হিজরি সন।
মহররম মাসটি ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। আকাশ-জমিন সৃষ্টিসহ অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসের ১০ তারিখে অর্থাৎ আশুরার দিনেই সংঘটিত হয়েছিল। পৃথিবীতে অনেক স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা এ দিন ঘটেছিল। মহররম সংগ্রামী শিক্ষার এবং আত্মসচেতনতার মাস। মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী চেতনা খুঁজে পাওয়ার মাস। মহররম আসে দায়িত্ব পালনে সাহসিকতার পথপ্রদর্শক হিসেবে। আসে নির্ভীকভাবে পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্তা নিয়ে। মহররম আসে পুরনো বছরের জরাজীর্ণতাকে ধুয়ে মুছে নতুন সাজে সজ্জিত করতে। এ মাস আসে আমাদের নতুন শপথ ও প্রত্যয় গ্রহণের অঙ্গীকার নিয়ে। মহররম মাস এলে মুসলিম বিশ্বে জেগে ওঠে ইসলামী সংস্কৃতি।
মহররম মাসে বহু উল্লেখযোগ্য ও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ঘটনা সঙ্ঘটিত হওয়ায় বিভিন্ন দিক দিয়ে এ গুরুত্ব অপরিসীম। মহররমের দশম দিবসে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে- (১) পৃথিবীর সৃষ্টি ও ধ্বংস (২) প্রথম মানব হজরত আদম আ:-কে সৃষ্টি করা এবং একই দিনে তাঁর জান্নাতে প্রবেশ (৩) হজরত আদম আ:-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর তার সাথে বিবি হাওয়াকে আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে পুনঃসাক্ষাৎ লাভ (৪) ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইউব আ:-কে সুস্থতাদান (৫) হজরত ইদ্রিস আ:-কে আকাশে উত্তোলন (৬) হজরত নূহ আ:-কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ প্রদান (৭) হজরত ইব্রাহিম আ:-কে অগ্নিকুণ্ড থেকে নিষ্কৃতি দেয়া (৮) হজরত দাউদ আ:-কে বিশেষ ক্ষমা প্রদান (৯) হজরত সোলায়মান আ:-কে হারানো বাদশাহী ফিরিয়ে দেয়া (১০) হজরত ইউনূস আ:-কে ৪০ দিন পর মাছের উদর থেকে উদ্ধার (১১) হজরত ইয়াকুব আ: কর্তৃক হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ আ:-এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ (১২) হজরত মুসা আ:-এর ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি লাভ (১৩) হজরত ঈসা আ:-কে জীবিতাবস্থায় আকাশে উত্তোলন (১৪) সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা:) মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফে আগমন (১৫) হজরত ইমাম হুসাইন রা: এবং তার ৭৭ ঘনিষ্ঠজন স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শহাদতবরণ প্রভৃতি প্রণিধানযোগ্য। মহররম মাসেই ফেরেশতাদের দিয়ে প্রথম সৃষ্ট মুসলমানদের পুণ্যভূমি কাবাগৃহ তৈরি করা হয়। এ দিনেই তুর পাহাড়ের পাদদেশে হজরত মুসা আ:-এর আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন এবং মুসা আ: নবুওয়াত ও তাওরাত কিতাব লাভ করেছিলেন।
হিজরি সাল তথা আরবি চান্দ্রবর্ষের মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র আশুরা ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও ব্যাপক তাৎপর্যময় দিবস। অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায় ও সত্য আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ মর্মস্পর্শী হৃদয়বিদারক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয় এ দিন। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ, অর্থাৎ ৬১ হিজরি সালে ১০ মহররম আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরীর অদূরে, ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন রা: বিশ্বাসঘাতক ও অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার পরিজনসহ ৭২ জন সঙ্গীসমেত নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। ১০ মহররম আশুরার দিনে বিষাদ সিন্ধুসংবলিত কারবালার এ নির্মম ঘটনা ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের দীক্ষা এবং জিহাদের শিক্ষা। অন্যায়কে প্রতিরোধ করে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার আদর্শ আমরা এ ঘটনা থেকে গ্রহণ করতে পারি। জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে কারবালার শহীদরা ন্যায়, সত্য ও আদর্শকে চিরভাস্বর করে রেখে গেছেন। সেই হৃদয়ভাঙা বেদনাকে স্মরণ করে ১০ মহররম মুসলিম বিশ্ব এই শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনা এবং ইবাদত বন্দেগি করে থাকে।
হজরত মোহাম্মদ (সা:) ইরশাদ করেছেন, মহররম মাসের আশুরার দিনে রোজা রাখলে আগের এক বছরের গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। এ মাসে হজরত রাসূল্লাহ সা:-এর প্রতি অধিকসংখ্যক দরুদ ও সালাম পেশ, নফল নামাজ আদায়, কুরআন মজিদ তিলাওয়াত, আশুরার দিনে এবং অন্য দিনেও রোজা পালন, হাদিস শরিফ অধ্যয়ন, দান-সাদকাহ প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য- বিশেষভাবে ইসলামের কল্যাণে জীবনকে নিবেদিত করা উচিত। আশুরার রজনী এক মহিমান্বিত, সম্মানিত, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, পুণ্যময়, বরকতময় ও মহাপবিত্র রাত্রি। এ রজনীতে উম্মতে মুহাম্মদির মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করা হয়। এ রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বিপুল ও সুদূরপ্রসারী। ইসলামে বিরাট গুরুত্ব মূল্যবোধ ও নৈতিকতার। ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা না থাকলে সমাজে কেউ নিরাপদ থাকে না। মহররম সব অন্যায়, পাপাচার, অনাচার ও সহিংসতাকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্মিকভাবে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শাশ্বত শিক্ষা দেয়।